Transcript for:
বাজির মাধ্যমে জীবনদর্শন

সময়টা ছিল শরতের এক অন্ধকার রাত বুড়ো ব্যাংকার তার পড়ার ঘরের মধ্যে যাওয়া আশা করছিলেন আর মনে করছিলেন ঠিক 15 বছর আগের এক শরতের সন্ধ্যার কথা সেইদিন সন্ধ্যায় তিনি একটা পার্টি দিয়েছিলেন অনেক জায়গায় থেকে অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষের ভিড় হয়েছিল সেদিন সেই আড্ডায় অনেক মজার বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল হঠাৎ একসময় কথা উঠে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট বা মৃত্যুদণ্ড নিয়ে অতিথিদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন এর বিপক্ষে তারা সবাই বলেছিলেন এ ধরনের শাস্তি হলো অনৈতিক আর দেশে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের প্রচলন করা উচিত আমি আপনাদের সাথে রাজি হতে পারলাম না আমার মতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ড অনেক বেশি নৈতিক কারণ মৃত্যুদণ্ড আসামিকে এক নিমেশেই শেষ করে দেয় কিন্তু যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে আসামির মৃত্যু হয় তিলতিল করে বছরের পর বছর ধরে এই কথা শুনে এক 25 বছরের তরুণ আইনজীবী বলে ওঠেন দুটোই হলো সমানভাবে অনৈতিক কারণ দুটোর উদ্দেশ্যই হলো মেরে ফেলা দেশ কোন ঈশ্বর নয় আর যার কোন কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা নেই তার ধ্বংস করারও অধিকার নেই কিন্তু তাও আমাকে যদি মৃত্যুদণ্ড আর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হয় তাহলে আমি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকেই বেছে নেব কারণ একেবারে মরে যাবার চেয়ে কোনভাবে বেঁচে থাকা অনেক ভালো আমি এটা কোনভাবেই মানতে পারলাম না দুই মিলিয়ন টাকা আমি বাজি রাখতে পারি যদি আপনি একা এরকম কোন নির্জন বাড়িতে পাঁচ বছর পর্যন্ত থাকতে পারেন আপনি যদি সত্যিই দুই মিলিয়ন রুবেল বাজি ধরতেই চান তাহলে আমিও রাজি আর এর জন্য আমি শুধু পাঁচ বছর নয় 15 বছরের জন্য বন্দি থাকতে রাজি আছি এভাবেই সকলের উপস্থিতিতে এই যুক্তিহীন বাজি গ্রহণ করা হলো সেই সময় ব্যাংকার অঢেল টাকার অহংকারে সঙ্গে সঙ্গে এই শর্তে রাজি হয়ে গেলেন তবুও তিনি শেষবারের মতো যুবকটিকে সাবধান করে দিতে চাইলেন এখনো সময় আছে ভালোভাবে একবার ভেবে দেখে নাও আমার কাছে এই দুই মিলিয়ন কিছুই না কিন্তু তুমি তোমার মূল্যবান তিন কিংবা চারটি বছর হারিয়ে ফেলবে কারণ আমি মনে করি তুমি এর থেকে বেশি সময় ওখানে টিকতেই পারবে না আর আজ এখন হাঁটতে হাঁটতে ব্যাংকার মনে মনে ভাবতে লাগলেন আচ্ছা সেই বাজির উদ্দেশ্য আসলে কি ছিল এতে কি আদৌ প্রমাণ হতো যে মৃত্যুদণ্ড আসলে কারাদণ্ডের থেকে ভালো নাকি খারাপ এতে শুধু সেই তরুণের 15 টি বছর নষ্ট করা হতো আর আমার দুই মিলিয়ন টাকা ছুড়ে ফেলে দেওয়া হতো আসলে সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই ছিল এক অর্থহীন পাগলামি এরপর তিনি আবার মনে করতে লাগলেন সেই সন্ধ্যার পরবর্তী ঘটনাগুলো এই বাজিতে ঠিক করা হয়েছিল সেই যুবক সেই ব্যাংকারেরই বাগানের এক বাড়িতে অত্যন্ত কঠোর পর্যবেক্ষণে পার করবেন তার নির্জন বছরগুলো এই 15 বছরের মধ্যে তিনি কখনো সেই বাড়ির চৌকাঠ পেরুতে পারবেন না কারো সাথে দেখা করতে পারবেন না কারো কণ্ঠস্বর শুনতে পারবেন না কোন চিঠি এমনকি খবরের কাগজও পড়তে পারবেন না তবে তিনি চাইলে তাকে যেকোনো বই বা বাদ্যযন্ত্র দেওয়া হবে তিনি চিঠি লিখতে পারবেন মদ্যপান আর ধূমপানও করতে পারবেন বাইরের জগতের সঙ্গে তার সংযোগ হবে শুধুমাত্র একটি জানালার মাধ্যমে সেই জানালা দিয়ে তার চাহিদা মতো বই মদ ইত্যাদি সবই তাকে পৌঁছে দেওয়া হবে 1870 সালের 14ই নভেম্বরের রাত বারোটা থেকে শুরু করে 1885 সালের 14ই নভেম্বর রাত বারোটা পর্যন্ত তাকে বন্দি করে রাখা হবে তিনি যদি এই 15 বছরের মধ্যে কোন শর্ত ভাঙ্গার চেষ্টা করেন এমনকি শেষ সময়ের হয়তো দুই মিনিট আগেও পালানোর চেষ্টা করেন তাহলেও তিনি হেরে যাবেন আর ব্যাংকারের দুই মিলিয়ন টাকা তিনি আর পাবেন না তার বন্দি জীবনের প্রথম বছরে তিনি একাকিত্ব আর হতাশায় ভুগছিলেন তার বাড়ি থেকে দিন-রাত পিয়ানোর সুর শুনতে পাওয়া যেত তিনি মদ কিংবা ধূমপানে বিরত ছিলেন কারণ তিনি মনে করতেন এগুলো ছিল স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ এই সময় তিনি কিছু ভালোবাসা সংক্রান্ত উপন্যাস এবং মজার মজার গল্পের কিছু বই পড়েছিলেন দ্বিতীয় বছর তার ঘর থেকে আর তিয়ানোর আওয়াজ শোনা যায়নি এই সময় তিনি শুধুই ক্লাসিক বইগুলো পড়েছিলেন পঞ্চম বছরে তার ঘর থেকে আবারো সুর শোনা যেতে লাগলো এই সময় তিনি খাবার খেতেন মদ পান করতেন আর শুয়ে থাকতেন তিনি কোন বই পড়তেন না কখনো হয়তো রাতে লিখতে বসতেন ঘন্টার পর ঘন্টা লিখেই যেতেন আর সকাল হলেই নিজেই সেগুলো ছিড়ে টুকরো টুকরো করতেন মাঝে মাঝে তাকে কে কাঁদতেও শোনা যেত তিনি তার ষষ্ঠ বছরে ভাষা দর্শন ও ইতিহাস নিয়ে পড়তে শুরু করলেন তিনি তার পড়াশোনার মধ্যে এতটাই ডুবে গেলেন যে তার এইসব বইয়ের চাহিদার যোগান দিতে ব্যাংকারকেও বেশ কষ্ট করতে হতো তিনি চার বছরের মধ্যে 600 ভলিউমের মত বই পড়লেন সেই সময় তার কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছিলেন যাতে লেখা ছিল ডিয়ার জেলার আমি আপনাকে এই চিঠিটা ছয়টি ভাষায় লিখেছি দয়া করে যারা এই ভাষাগুলো জানেন তাদের এই চিঠিটা দেখাবেন এবং তাদের পড়তে বলবেন যদি তারা এর মধ্যে কোন ভুল না পেয়ে থাকেন আমার অনুরোধ থাকবে আপনি যেন তখন বাগানে এসে বন্দুকের একটা গুলি ছুড়েন সেই গুলির শব্দ শুনলে আমি বুঝতে পারবো আমার এতদিনের কষ্ট বিফলে যায়নি দশম বছর শেষে যুবকটি 600 ভলিউমের ধর্মীয় গসপেল এক বছরের মধ্যে পড়ে শেষ করে ব্যাংকারকে অবাক করে দিলেন গসপেল শেষ হলে তিনি ধর্মতত্ত্ব আর ধর্মীয় ইতিহাস নিয়ে পড়লেন তার বন্দি জীবনের শেষ দুই বছর তিনি কোন রকম বাঁচবিচার ছাড়াই অজস্র পরিমাণ বই পড়ে গেলেন কোন সময় হয়তো তাকে কে দেখা গেল বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে আবার তারপরেই হয়তো তিনি চেয়ে বসলেন বায়রন অথবা শেক্সপিয়ার এই সময় তিনি রসায়ন ঔষধ বানাবার বই উপন্যাস ও দর্শন পড়ে ফেলেন বুড়ো ব্যাংকার এখন ভাবতে লাগলেন আগামীকাল 12:00 টায় সে বেরিয়ে আসবে চুক্তি অনুযায়ী আমাকে দিতে হবে দুই মিলিয়ন টাকা আর এতগুলো টাকা চলে গেলে আমি হয়ে পড়বো সর্বশান্ত এই 15 বছরে ব্যাংকারের জীবনেও অনেক পরিবর্তন এসেছে সে এখন আর আগের মতো নেই স্টক এক্সচেঞ্জে ইনভেস্টমেন্ট ও তার খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত তাকে এখন নিঃস্ব করে ফেলেছে কালকে সে মুক্তি পেয়ে যাবে আর আমাকে দিতে হবে দুই মিলিয়ন টাকা তার বয়স খুব বেশি বললে 40 হবে সে কালকে হয়ে যাবে দুই মিলিয়ন টাকার মালিক তারপর সে বিয়ে করবে জুয়া খেলবে আর জীবনটাকে উপভোগ করবে আর আমি ভিক্ষুকের মত জীবন যাপন করব এটা আমি কোনভাবেই হতে দেবো না তাকে আজকে রাতে মরতেই হবে ঘড়িতে তিনটার ঘন্টা [মিউজিক] বাজলো সেই সময় বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে এমন সময় হাটে হিম ধরা শীতের রাতে সেই ঘরের চাবিটা নিয়ে ব্যাংকার সেই ঘরের দিকে গেলেন বাগানে ছিল কনকনে ঠান্ডা আর গভীর অন্ধকার তিনি দারোয়ান কে ডাকলেন কিন্তু কোন শব্দ পেলেন না অন্ধকারে ধীরে ধীরে তিনি বাড়িটার সিঁড়ি দিয়ে উঠলেন এবং সেখানটা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলেন অন্ধকারে মাচিসের আলোতে তিনি বন্দির ঘরের দরজার কাছে গেলেন ব্যাংকার সেই ছোট জানালাটি দিয়ে উঁকি দিলেন ঘরের ভেতরে ঘরে টিন টিন করে জ্বলছিল একটি মোমবাতি বন্দি বসেছিলেন টেবিলের সামনে ব্যাংকার চাবি খুলে ভেতরে ঢুকলেন ব্যাংকার দেখলেন সেখানে চারিদিকে শুধু অজস্র বই তিনি ভাবছিলেন এখনই হয়তো উঠে পড়বে সেই ব্যক্তি কিন্তু তার কাছ থেকে কোন শব্দ নেই ব্যাংকার ধীরে ধীরে সেই ব্যক্তির কাছে গেলেন সে টেবিলের ধারে চুপচাপ মূর্তির মত অটল ও অনর হয়ে বসেছিল তার শরীর ছিল কঙ্কালের মত ব্যাংকার ভাবতে লাগলেন কিভাবে তাকে মারা যায় এমন সময় তিনি দেখলেন টেবিলের উপর একটা চিরকুট পড়ে আছে তিনি সেটা পড়তে শুরু করলেন সেটাতে লেখা ছিল আগামীকাল 12:00 টায় আমি আবার আমার স্বাধীনতা ফিরে পাবো ফিরে পাবো অন্য সব মানুষের সাথে চলাফেরা করার অধিকার এই 15 বছরের বন্দি জীবনের সময় আমি অনেক বই পড়েছি অধ্যয়ন করেছি নিজেকে উন্নত করেছি আমি এখন আর সাধারণ মানুষের মত পৃথিবীকে দেখতে চাই না যেখানে বাহ্যিক সম্পদই সবকিছু আমার কাছে এখন সমস্ত বাহ্যিক ভোগবিলাস অর্থহীন মনে হয় আমি শিখেছি শান্তি আত্মসম্মান এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানই জীবনের আসল মূল্য আমি যখন প্রথম এই বাজি শুরু করেছিলাম তখন মনে করেছিলাম যে দুই মিলিয়ন রুবেল আমার জীবনের সমস্ত কিছু হয়ে উঠবে কিন্তু এখন আমি জানি সেই অর্থ আমার জীবনের জন্য একদম অপ্রয়োজনীয় আমি এখন বুঝতে পেরেছি এই 15 বছরে যে জিনিসগুলো আমি শিখেছি তার তুলনায় এক কোটি রুবেলও মূল্যহীন তাই দুই মিলিয়ন রুবেল আমি অস্বীকার করছি কালকে আমি ঘর থেকে নির্ধারিত সময়ের পাঁচ ঘন্টা আগেই বেরিয়ে যাব আর ভেঙ্গে দেবো সেই চুক্তির শর্ত বুড়ো ব্যাংকার কাগজটা রেখে দিলেন টেবিলে আর কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি নিজের বাড়িতে আসলেন শুয়ে পড়লেন বিছানায় কিন্তু তার কান্না আর অনুভূতিরা তাকে জাগিয়ে রেখেছিল অনেকক্ষণ পর্যন্ত পরের দিন সকালে দারোয়ান দৌড়ে এসে খবর দিল লোকটা সেখান থেকে পালিয়ে গেছেন ব্যাংকার তখনই তার দারোয়ানের সাথে বাগানবাড়ির দিকে যান আর দেখেন সত্যিই তিনি আর সেখানে নেই তিনি সেই কাগজখানা তুলে নেন যাতে সেই লোকটি অস্বীকার করেছিলেন সেই দুই মিলিয়ন টাকা আর বাড়িতে গিয়ে সেটা তিনি ঢুকিয়ে দিলেন একটি সুরক্ষিত সিন্দুকে মানুষের অযথা অহেতুক যত কথা এড়াতে [মিউজিক]